সেক্সুয়াল হেলথ ও মেন্টাল হেলথ – ৩
এই ছবিটা এখন প্রায় প্রতিটা পরিবারেরই সাধারন চিত্র। ঘুমাতে যাওয়ার আগে সেই যে ফোনের স্ক্রিনে বন্দী হই আমরা, তারপর আর খবর নেই।
মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট চালানোর সুবিধা আসার আগে মানুষ ঘুমিয়ে পড়তো ১১টা-১২টার মধ্যে, এখন ঘুমাতে পারে না ২টার আগে, অনেকেই জেগে থাকেন সারারাত। যাদের ঘুমানোর সুযোগ থাকে তারা ঘুমায় বেলা ১টা-২টা পর্যন্ত, যাদের সুযোগ নেই তারা ৭টায় উঠে ৯টার অফিস/কাজ ধরে।
স্লিপ সাইকেল বদলে যাওয়ার সমস্যাটা কি??
আমাদের শরীরের রক্ত সঞ্চালন, হরমোনাল সিক্রেশন, এনজাইম এক্টিভেশন এমনকি অনেক জিন এক্সপ্রেশন পুরোপুরি নির্ভরশীল আমাদের স্লিপ সাইকেলের ওপর। স্লিপ সাইকেল ড্যামেজড মানে, আপনার শরীরকে সমস্ত সিদ্ধান্ত নতুন করে নিতে হয়। কখন সে খাবার হজম করবে, কখন সে হার্টবিট বাড়াবে, কখন হার্টবিট কমাবে, কখন ব্রেইন রেস্ট নেবে, কখন লিভার ফাংশন বাড়বে, কখন শরীরের ড্যামেজ রিপেয়ার করা হবে, সব কিছু।
ড. শচীন পান্ডা তার বিখ্যাত বই দ্যা সার্কাডিয়ান কোডে দেখিয়েছেন, আমাদের শরীর একই সময়ে অনেকগুলি কাজ দক্ষতার সাথে করতে পারে না। শরীরের নিজস্ব কাজের ছন্দ ও বিন্যাস আছে, রুটিন আছে। আপনি রাত ১০টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত যদি মাত্র তিন ঘন্টা জেগে থাকেন, আপনার শরীর রাতের বেলার শিফট ওয়ার্কারদের মত কাজ করতে শুরু করবে। সকালের যে সময়টা আপনার শরীর সুপারচার্জড হওয়ার কথা, সে সময়ে আপনি মরার মত ঘুমাবেন। তবু, আপনার শরীর আর কখনোই সুপারচার্জড হবে না, হয়তো ৬০-৭০% পর্যন্ত হয়।
তো, এর সাথে সেক্সের সম্পর্ক কি??
পুরুষের ন্যাচারাল সেক্সুয়াল আর্জ সাইকেল সবচেয়ে বেশি এক্টিভ থাকে সকালে, সম্ভবত যেকোন পুরুষই ব্যাপারটা জানেন। কিন্তু কখনো চিন্তা করে দেখেছেন, কেন এটা ঘটে??
কারন, আপনার বডি এক্সপেক্ট করে, আপনি রাত ৯টা-১১টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়বেন, জাগবেন রাত ২টার পরে কোন এক সময়, তারপর আরেক দফা ঘুম হবে আপনার।
আপনি দিন শুরু করবেন ৬-৮টার মধ্যেকার কোন এক সময়ে। এই যে লম্বা একটা রিফ্রেশমেন্ট, মূলত এরপরেই কিন্তু পুরুষদের শরীর শক্তিশালী লিবিডো লাভ করে।
এখন, যদি আপনি এই রিফ্রেশমেন্ট না পান, আপনার লিবিডো ভাল হবে কি করে?? তার ওপর, সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই যদি এক ঘন্টা পর অফিসে যাবার তাড়া থাকে, It would be quiet impossible to have sex even at the strongest point of your libido.
আমাদের অনেকের আবার অভ্যাস আছে অফিস শেষ করে বসের পেছনে দু-তিন ঘন্টা সময় দেয়ার। ফলে আমরা বাসায় ফিরতে দেরি করি, রাতের মিল নিতে দেরি করি, এরপর ফোন চাপাচাপি করে ঘুমোতে দেরি করি। স্ত্রীর সাথে যোগাযোগের সময় এত ক্ষীন হয়ে আসে যে সেক্সের ব্যাপারটা আমাদের মাথাতেই থাকে না, বরঞ্চ চোখে নেমে আসে রাজ্যের ঘুম।
কিন্তু, এখানে আমরা দুটো ভুল করি।
১)বসকে তেল দেয়ার বিনিময়ে আমরা ঘুম স্যাক্রিফাইস করি, যা আমাদের টেস্টোস্টেরন লেভেল কমায়। ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগো পরিচালিত এক গবেষনায় পুরুষদের দুটো দলকে দিনে যথাক্রমে চার ও আট ঘন্টা ঘুমাতে দেয়া হয়। এরপর তারা ঘুম থেকে ওঠার পর তাদের টেস্টোস্টেরন লেভেল মাপা হয় এবং দেখা যায়, যারা আট ঘন্টা ঘুমিয়েছেন তাদের টেস্টোস্টেরন লেভেল চার ঘন্টা ঘুমানোদের চেয়ে ১২% বেড়েছে। এই গবেষনা হয়েছিল মাত্র ৯ দিনের জন্য, ১২ জন ৬৪-৭৪ বছর বয়সী পুরুষের জন্য। এখন, ফ্রি টেস্টোস্টেরন লেভেলের যদি ৯ দিনে এতখানি তফাত ঘটে তাহলে ১০ বছরে কতটা তফাত হতে পারে, ভাবুন।
২)বসকে তেল দিতে গিয়ে আমরা স্ত্রীর সাথে সময় কাটানোটা মিস করি। সেক্ষেত্রে আমাদের দাম্পত্য সম্পর্ক শিথিল হয়ে পড়ে, যার ফল দেখা যায় বিছানায়। সেক্সের সময় স্বামীরা স্ত্রীদের সাথে মানসিকভাবে একাত্ম হতে ব্যর্থ হন, ফলে কেউ না কেউ অতৃপ্ত থেকে যান। আর যদি ওয়ার্কিং ডে তে সেক্স না হয়(যা বেশি কমন), সেক্ষেত্রে এটা আবার আমাদের ঘুমকে নষ্ট করে। যেকোন মানুষই কোয়ালিটি সেক্সের পর গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হন। পুরুষদের অর্গাজম নারীদের চেয়ে বেশি হয়, ফলে পুরুষদের ঘুমও বেশি হয়। যেসব নারীদের অর্গাজম হয় তাদের ঘুমও অত্যন্ত জোরদার হয়। যদি আপনি সেক্স না করেন, বা কোয়ালিটি সেক্স না করেন, আপনার ঘুম হবে স্বাভাবিকের চেয়ে পাতলা।
এখন, এই যে কম ঘুমালেন, এর ফল আপনার সেক্স লাইফে কিভাবে পড়তে পারে??
১)আপনার ইরেক্টাইল/সেক্সুয়াল ডিজফাংশন হবে। ছেলেদেরও হবে, মেয়েদেরও হবে। জার্নাল অফ সেক্সুয়াল মেডিসিন ৪০১ জন পুরুষকে নিয়ে ২০০৯ সালে একটা স্টাডি করেছিল, যারা স্লিপ এপনিয়াতে ভুগছিলেন। তাদের ৭০% এরই ইরেক্টাইল ডিজফাংশন দেখা দিয়েছিল। জার্মানিতে ৪৯৫৫ জনের ওপর হওয়া আরেকটা গবেষনায় দেখা যায়, স্যাম্পল পপুলেশনের ৩৩% পুরুষ ও ৪৫% নারী বিভিন্ন মাত্রার সেক্সুয়াল ডিজফাংশনে ভুগছেন।
২)আপনি কাজে কর্মে ফোকাস হারাবেন। টেস্টোস্টেরন দিনে ঘুমালে না, রাতে ঘুমালে বাড়ে। অফিসে গিয়ে ঝিমান আর ঘুমান টেস্টোস্টেরন বাড়বে না। ঘুমের অভাবে আপনি একে তো কোনকিছু স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করতে পারবেন না, তেমনি টেস্টোস্টেরন লেভেল কমে গেলেও আপনার উৎপাদনশীলতা কমবে। আপনি ক্রমেই তখন আরো বেশি তেলবাজ হয়ে উঠবেন, ওদিকে আপনার সমস্যা কিন্তু অন্য জায়গায়।
৩)রাতে কম ঘুমানোয় আপনার কর্টিসোল লেভেল সঠিক সময়ে স্বাভাবিক পর্যায়ে নেমে আসে না, বা হয়তো কখনোই স্বাভাবিক হয় না। কর্টিসোল স্বাভাবিক লেভেল না থাকলে আপনি ক্রনিক স্ট্রেসে ভুগতে শুরু করবেন, ফলে আপনার টেস্টোস্টেরন লেভেল কমবে এবং এস্ট্রোজেন লেভেল বাড়বে। নারী বা পুরুষ যেকারো ক্ষেত্রেই এই হরমোনাল ইমব্যালেন্স তার সেক্সলাইফ ধ্বংসের কারন হয়ে দাঁড়াবে।
৪)সংসারে ঝগড়াঝাটি বাড়বে। রাতের ঘুম ঠিক না হওয়া মানে, আপনাদের সিদ্ধান্ত নেয়ার পদ্ধতি ক্রমেই অযৌক্তিক হতে থাকবে। আর এই ধরনের অযৌক্তিক একগুয়েমি শেষমেশ গিয়ে দাঁড়াবে ঝগড়ায়। ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার এক গবেষনায় দেখা গেছে যেসব দম্পতি কম ঘুমান তাদের মধ্যে ঝগড়াঝাটির হার ৭০% বেশি।
৫)আপনার এইজিং লেভেল বেড়ে যাবে। সোজাকথা, আপনি জলদি বুড়ো হবেন, দ্রুত ডায়বেটিস-হার্ট ডিজিজ-স্ট্রোক-অস্টিওপরোসিসে ভুগবেন এবং জলদি মারাও যাবেন।
তাহলে, সেক্স লাইফ ঠিক করতে হলে বিবাহিতদের করনীয় হচ্ছে আগে ঘুমকে ঠিক করা।
সঠিক সময় -রাত ১১টার মধ্যে ঘুমানো
সঠিক পরিমান-অন্তত দিনে ৭ ঘন্টা থেকে ৯ ঘন্টা ঘুমানো
এবং ঘুমানোর কিছুক্ষণ আগে সেক্স করার চেষ্টা করা।