প্যাশেন্টস ডায়েরি: পর্ব – ২
মিস তিশা (২৭)।
তিশার বয়স যখন এগারো তখন তার প্রথম মাসিক হয়। সতেরো বছর বয়সে তিশার ওজন ছিল ৫১ কেজি, উচ্চতা ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি, তখন তার নিয়মিত মাসিক হত। এসময় তার একটি ছেলের সাথে পরিচয় থেকে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। রাত জেগে টেক্সটিং শুরু করেন তিনি, ঘুমোতেন গড়ে রাত তিনটায়। রাত জেগে থাকায় রাত ১২টা-১টার দিকে প্রায়ই ক্ষুধা লাগতো, তাই বিস্কিট, পাউরুটি, জেলি বা কেক খেতেন। সপ্তাহে ১-২ দিন ডেইটে গেলে তার খাওয়া হত ফ্রাইড চিকেন, বার্গার/পিৎজা। উপহার হিসেবে তার জন্য মাঝে মাঝেই ছেলেটি চকোলেট-আইসক্রিম পাঠাতো।
এর কিছুদিন পর থেকে ক্রমেই তিশার তলপেটে ও নিতম্বে চর্বি জমতে শুরু করে। বয়স একুশ হওয়ার পর তিশার ওজন বেড়ে দাঁড়ায় ৬৬ কেজি। এই সময় থেকে তার অনিয়মিত মাসিক শুরু হয়। তিনি ক্রমেই মেজাজের ভারসাম্যহীনতায় ভুগতে থাকেন। এক এক করে নিজের কাছের মানুষদের সাথে তার দুরত্ব সৃষ্টি হতে শুরু করে। প্রায়ই মুড সুইংয়ের কারনে ঝগড়ার ঘটনা ঘটতে থাকে, ঝগড়ার পর অনেকক্ষেত্রেই বুঝতে পারেন ভুল নিজেরই ছিল কিন্তু রাগের কারনে তা স্বীকারও করতে চান না। নিজের ক্রমেই বেড়ে চলা ওজনের সাথে সাথে বাড়তে থাকে সুগার ক্রেইভিং, শরীরের দিকে তাকালে হতাশায় ছেয়ে যায় মন। ওদিকে মিড সুইং-ডিপ্রেশন মিলে তার সাথে বয়ফ্রেন্ডের সম্পর্কের মারাত্মক অবনতি ঘটে। এসময় তার ওজন ৭৫ ছাড়িয়ে যায়।
সম্পর্ক ভেঙ্গে যায়। পরিবার থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকে, ওদিকে নিজের শারীরিক অবস্থা নিয়ে ক্রমেই হতাশ হতে থাকেন তিশা। এরই মধ্যে ধরা পড়ে পিসিওএস(পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিন্ড্রোম) এবং প্রিডায়বেটিস। ডাক্তার প্রজেস্টেরন পিল এবং মেটফরমিন দেন। লো ক্যালরি ডায়েট চার্ট একটা ফেইসবুক গ্রুপ থেকে নিয়ে ফলো করতে শুরু করেন। কয়েক মাস ফলো করার পর দেখা যায় এনিমিয়া শুরু হয়েছে এবং প্রচন্ড দুর্বলতা জেকে বসেছে।
ইতোমধ্যেই তিশার রাতের ঘুম বা স্লিপ সাইকেল পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। চিনি না খেলে তার কিছুই ভাল লাগে না, সারাক্ষন মেজাজ খিটখিট করে। দিনে ৭-৮ বার খেতে হয় তাকে, যতক্ষন সজাগ থাকেন ততক্ষনই কিছু না কিছু তিনি খান।
আমার কাছে যখন তিশা আসেন, তখন তার ওজন ৮২ কেজি, উচ্চতা ৫.৫ ফুট, পেটের নিচের দিকটায় অনেক বড় চর্বির স্তর। মাসিক হয় নি শেষ ৬ মাসেও। কোমরে-হাটুতে ব্যথা শুরু হয়েছে।
বন্ধু-বান্ধব-পরিবারের সদস্য কারো সাথেই সম্পর্ক ভাল না সারাক্ষন নেতিবাচক চিন্তাভাবনা-মিড সুইং আর হতাশার কারনে। বাসা থেকে বিয়ে দিতে চাচ্ছে কিন্তু তিনি বিয়ে করতে চাচ্ছেন না। তার কিছুই ভাল লাগে না।
এই কেইসটার টার্নিং পয়েন্টসঃ
১) রাত জাগা শুরু করা সমস্ত সমস্যার মা। বিশেষভাবে, টিনেজ বয়স থেকে রাত জাগা শুরু করা খুবই বিপজ্জনক। এটা ওজন বাড়া, হতাশা, খিটখিটে মেজাজ, সুগার ক্রেইভিং, ডায়বেটিস সবকিছুর জন্য দায়ী।
২) প্রসেসড ফুড-ফাস্ট ফুড খাওয়া দীর্ঘমেয়াদে আত্মঘাতী, নারীপুরুষ সবার জন্যই। প্রায় ৭৫-৮০% পিসিওএস কেইসে প্রসেসড ফুডের অভ্যাস থাকার ইতিহাস পাওয়া যায়।
৩) লেটনাইট/মিডনাইট স্ন্যাক্স-এটা আরেক বদ অভ্যাস। লেটনাইট-মিডনাইট স্ন্যাক্স আসলে আমাদের ঘুম যেমন নষ্ট করে, তেমনি নষ্ট করে স্বাভাবিক ইনসুলিন সিক্রেশনের সময়। ফলে সারাদিন ইনসুলিনের প্রবাহ অব্যাহত থাকায় আমরা হাইপারইনসুলিনেমিয়াতে ভুগতে শুরু করি।
৪) অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রেম নিজে একটা স্ট্রেসের উৎস। নিয়মিত হেলদি সেক্স ও ইমোশনাল এফিনিটির সুযোগ না থাকলে যেকোন সম্পর্ক নিজেই স্ট্রেস উৎপাদন করে। ক্রনিক স্ট্রেস ডায়বেটিস সহ সমস্ত রোগের প্রিকারসর।
৫) লো ক্যালরি ডায়েটের চিরসঙ্গী দুর্বলতা।
সুস্থ থাকতে চাইলে রাত জেগে মোবাইলে চ্যাট করা বন্ধ করতে হবে। যাদের ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি তারা কোনক্রমেই রাত জাগবেন না।
মিডনাইট স্ন্যাক্স-লেট নাইট স্ন্যাক্স কালচার থেকে বেরিয়ে আসতে হবে আমাদের সবাইকে।
স্ন্যাক্স হিসেবে ফাস্টফুডকে বয়কট করতে হবে।
মুড সুইংকে এস্থেটিক মনে করার কোন কারন নেই। নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে এটা একটা রোগ যার চিকিৎসা লাইফস্টাইলে।
অনিয়মিত পিরিয়ড এবং তলপেটে চর্বি জমার ঘটনা একসাথে ঘটলে দেরি না করে গাইনোকলোজিস্ট ও ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশনিস্টের শরনাপন্ন হওয়া উচিত।
মুড সুইং-ডিপ্রেশনের কারনে যদি ফ্যামিলির টিনেজ-তরুনী মেয়েরা অন্যদের সাথে বাজে ব্যবহার করে, তার সাথে কথা বলুন, প্রয়োজনে চিকিৎসা নেয়ান। তাকে তার মত ছেড়ে দেয়া ভবিষ্যতে বিপদের কারন হয়ে দাঁড়াবে।
মেটফরমিন দিয়ে প্রিডায়বেটিস ম্যানেজ করা যায়, কিউর করা যায় না। প্রিডায়বেটিস কিউর করতে হলে চাই ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং ও এক্সারসাইজের সাথে লো কার্ব ডায়েট।
বিয়েতে অনীহা করে অসুস্থতাকে এড়ানো যায় না। অসুস্থতার চিকিৎসা করতে হয়, তারপর সুস্থ হয়ে বৈবাহিক জীবনে প্রবেশের চেষ্টা করতে হয়। জীবনে যা এড়াতে পারবেন না, তাকে মোকাবিলা করাটাই সঠিক এপ্রোচ।