প্যাশেন্টস ডায়েরি: পর্ব – ৮
বাহরাইন প্রবাসী তৌফিকুল আলম যখন দেশে ফিরে আমার কাছে দেখাতে এলেন, ততক্ষনে ঘাড়, কোমর ও হাত পায়ের বাকি সমস্ত জয়েন্টের অবস্থার বারোটা বেজে গেছে। শরীরের যেখানেই হাত দেয়া হয় তিনি বলেন শুধু ব্যথা।
ভদ্রলোক যখন দেশের বাইরে পাড়ি জমান তখন তার বয়স মাত্র ২১ বছর। দেশে চলে এসেছেন ১৮ বছর পর।
প্রথমে তিনি ছিলেন ইলেক্ট্রিশিয়ান। ইলেক্ট্রিক কাজ করতে প্রায়ই তাকে রোদে থাকতে হত। কিন্তু শখের বশে শেখা আরেকটা কাজ তাকে পেশা বদলে ফেলতে ও আয় বাড়াতে সাহায্য করে, সেটা হচ্ছে জুয়েলারি।
বাহরাইন যাওয়ার ৪ বছরের মধ্যে তিনি মেসের এক পাকিস্তানির কাছ থেকে খুব ভাল জুয়েলারি শিখে ফেলেন এবং একটা জুয়েলার্সে কাজ করতে শুরু করেন। দেশে ফিরে ধুমধাম করে বিয়ে করেন ২৬ বছর বয়সে। বিয়ের পর ৬ মাস দেশে থেকে আবার ফিরে যান বাহরাইন।
অদ্ভুত কারনে বিয়ের ২ বছরের মাথায় তার স্ত্রী তার ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে যৌতুক মামলা করেন। শুরু হয় তৌফিকের কঠিন সময়।
তার ডিভোর্স হয়ে যায় ঘটনার ২ বছর পর। মামলার সমস্ত বিষয় সমাধান হতে হতে লেগে যায় আরো দুই বছর।
তৌফিক সাহেবের জমানো সঞ্চয়ের সিংহভাগ খরচ হয়ে যায় মামলায়। ফলে তাকে আরো বেশি সময় থাকতে হয় বাহরাইনে।
দিনরাত কাজ করে করে ক্লান্ত শ্রান্ত শরীরের ওপর আসতে থাকে নানাবিধ মানসিক চাপ, এত চাপ নিয়ে শেষে তৌফিক সাহেবের শুরু হয় হাইপারটেনশান আর কোমর ব্যথা। ব্যাপারটা আরো খারাপের দিকে যায় যখন তার ওজন বেড়ে ৮৫ কেজি পার হয়ে যায় এবং গ্রেড টু ফ্যাটি লিভার ধরা পড়ে।
তৌফিক সাহেব তার জীবনটাকে আবার নতুন করে সাজাতে চান, তাই অনলাইনে বিভিন্ন পেইজে ঘুরে ঘুরে শেষে আমাদের পেইজটায় লাইক দেন এবং বুঝতে পারেন, লাইফস্টাইল ও ডায়েট চেঞ্জ করেই ফ্যাটি লিভার থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব।
দেশে ফেরার পর গত বছর প্রথমে তার আল্ট্রাসনোগ্রাম, লিপিড প্রোফাইল, ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স, ভিটামিন ডি ও টেস্টোস্টেরন লেভেল চেক করতে দিলাম।
ডি আসলো ৭.২!!
ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স ইনডেক্স-৪.৯, এইচডিএল-২২, ট্রাইগ্লিসারাইড-৭২৫, ফ্রি টেস্টোস্টেরন লেভেল-১১.৫।
সাথে হাইপারটেনশান, ফ্যাটি লিভার গ্রেড টু আর প্রিডায়বেটিস, চরম রকমের ঘাড়-কোমর ব্যথা।
এক্সরে তে দেখা গেল, হাড় ক্ষয় হয় নি।
শুরু করলাম নিউট্রিশনাল থেরাপি। তাকে দেয়া হল লো কার্ব, মডারেট ফ্যাট ডায়েট, সাথে হাই ডোজ ভিটামিন বি-১, ভিটামিন ডি থ্রি-কে-২ ও ম্যাগনেসিয়াম থেরাপি এবং আরো কিছু ভাইটাল নিউট্রিয়েন্টস।
৬ মাসে ৪ টা ফলো আপ নেয়ার পর তিনি যখন আবার বাহরাইনে গেলেন তখন তার ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স ছিল ২.২(প্রায় স্বাভাবিক), ফ্যাটি লিভার ছিল গ্রেড ওয়ান, লিপিড প্রোফাইলে ট্রাইগ্লিসারাইড ছিল ২৩৫।
যেহেতু প্রিডায়বেটিকদের টেস্টোস্টেরন লেভেল বাড়তে সময় লাগে তাই তার টি লেভেল বেশি বাড়ে নি, ১৪.৮ হয়েছিল।
ভদ্রলোক আবার দেশে ফিরেছেন এই মাসে। সেদিন চেম্বারে যখন তার রিপোর্টগুলো দেখছিলাম, অনাবিল আনন্দে ভরে গেল মন। ৩৯ বছর বাংলাদেশী পুরুষের জন্য একেবারে কম বয়স না।
এই বয়সে আবার তিনি সংসার শুরু করতে চাইছেন।
এক বছর তিন মাসের ডায়েট ও লাইফস্টাইল চেঞ্জ তার টেস্টোস্টেরন লেভেলকে নিয়ে গেছে ২৮.৮ এ, লিপিড প্রোফাইল এখন স্বাভাবিকের চেয়েও ভাল, এইচডিএল-৫৫, ট্রাইগ্লিসারাইড ১৫৩, ভিটামিন ডি-৬৮।
ফ্যাটি লিভার, প্রিডায়বেটিস কোনটাই নেই, একটা সিমেন এনালাইসিস করাতে বলেছি বিয়ের আগে, হয়তো শিগগিরই করবেন।
তৌফিকুল আলম এখন বিয়ের জন্য সম্পুর্ন তৈরি।
তাকে ধ্বংস করে ফেলেছিল মানসিক চাপ ও চারপাশের মানুষের স্বার্থপর আচরন, হতাশা আর অস্বাস্থ্যকর খাবার। মাত্র সোয়া এক বছরের লাইফস্টাইল চেঞ্জেই তিনি স্বাভাবিক, শুরু করছেন নতুন জীবন।