ব্যালেন্সড ডায়েট কি সবার জন্য এক?
সমস্ত মানুষের জন্যই কি কোন ব্যালেন্সড ডায়েট থাকতে পারে?
একটু ভেবে দেখলেই আপনি বুঝতে পারবেন, ব্যালেন্সড ডায়েট জিনিসটা আপেক্ষিক। কারন ব্যালেন্স শব্দটাই আপেক্ষিক।
একেকজনের জন্য তাই একেক রকম।
উদাহরন দেই।
ডায়েট করতে চাইলে প্রথমে আপনাকে কিছু জিনিস জানার প্রয়োজন পড়ে।
যিনি ডায়েট করবেন, তার-
১) শারীরিক ওজন, উচ্চতা ও বয়স
২) শরীরের কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশের মাপ
৪) দৈনিক শারীরিক ও মানসিক কার্যক্রম
৫) বিশেষ শারীরবৃত্তীয় অবস্থা
৬) অসুস্থতা ও ঘাটতির অবস্থা
৭) আর্থিক অবস্থা
৮) চারপাশের আবহাওয়া ও পরিবেশ
এই বিষয়গুলি ভালভাবে না বুঝলে ঐ ব্যক্তির শরীর কি চায় তা ঠিকভাবে জানা যায় না। এমনকি, সঠিক জ্ঞান না থাকলে এই তথ্যগুলি হাতে থাকলেও তা ব্যবহার করা যায় না।
… … …
এখন ধরেন, কোন বাসায় একজন ৭০ বছরের বৃদ্ধ, একজন ৬৩ বছরের বৃদ্ধা, একজন ৪০ বছরের পুরুষ, ৩৫ বছরের নারী, ১৬ বছর ও ১২ বছরের দুজন ছেলে, ১৪ বছরের একজন মেয়ে এবং ২ বছরের আরেকজন মেয়ে আছেন। সাথে তাদের পরিচারিকা হিসেবে আছেন ২০ বছরের আরেকজন মেয়ে।
মোট ৯ জন মানুষ।
ধরা যাক, ৭০ ও ৬৩ বছর বয়সের দুজনই ডায়বেটিক, বৃদ্ধ লোকটির উচ্চ রক্তচাপ আছে, কিন্তু তিনি তেমন দুশ্চিন্তা করেন না। ওদিকে, বৃদ্ধার দুশ্চিন্তা প্রচুর, কিন্তু রক্তচাপ স্বাভাবিক। বৃদ্ধার রক্তচাপের পাশাপাশি ডায়বেটিস আনকন্ট্রোল্ড, দুজনেরই কোমরে ব্যথা আছে খানিকটা।
আবার, ৪০ বছর বয়সের পুরুষটি যিনি, তার ওজন তেমন বেশি না, ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি উচ্চতায় ওজন ৬৫ কেজি। পেটে তেমন চর্বি নেই, কোমর ৩২। মোটা না হওয়ার পরেও রক্তচাপ প্রায়ই বেশি থাকে, মাঝে মাঝে রাতে ভাল ঘুম হয় না। ঘন ঘন খিদে পায় আর অল্প কিছু খেয়ে নেন চট করে। একসাথে বেশি খান না। বাড়তি চর্বিযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলেন, ফাস্টফুডও তেমন খান না। আসলে তিনি বেশি খাওয়া দাওয়াই করেন না। শরীর তুলতুলে নরম। দিনে নিয়ম করে হাটেন এক ঘন্টা।
৩৫ বছর বয়সী মহিলাটির সারাদিনই শরীর ব্যথা করে, মাঝে মাঝে চোখে সামান্য ঝাপসা দেখেন তিনি, কিছু ভাল লাগে না সব বিরক্তিকর লাগে। তার পেটে চর্বিও আছে বেশ খানিকটা। ছোট বাচ্চাটাকে দুধ খাওয়াচ্ছেন, ইদানিং মাসিক মাঝে মাঝেই অনিয়মিত। ওজন দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে, সেই সাথে বাড়ছে দুর্বলতা আর গা ব্যথা, মাঝে মধ্যে হাটুও ব্যথা করে। সারাদিনই ক্লান্ত লাগে, স্বামী বাসায় আসলে ভাল করে কথা বলতে ইচ্ছা করে না, রাতে ঠিকমত উত্তেজিতও হন না, ফলে শারীরিক মিলনে আগ্রহ বোধ করেন না। প্রায়ই হতাশা-বিষাদে ভোগেন।
বাকি যে ছেলেমেয়েগুলো আছে এদের মধ্যে ১৪ বছর বয়সী মেয়েটার ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশ বেশি। ৫ ফুট ১ ইঞ্চি উচ্চতায় মেয়েটার ওজন প্রায় ৭০ কেজি। চোখে চশমা লেগেছে, হাত পা প্রায়ই ব্যথা করে। মাসিক অনিয়মিত, সারাক্ষণই ক্লান্ত লাগে, রাতে ঘুম হয় না। কোমর যেখানে এই বয়সে ২২-২৬ ইঞ্চির বেশি হওয়ার কথা না সেখানে তার কোমরের মাপ ৩০ ইঞ্চি। যখন তখন তার ক্ষুধা পায়, রাতে ঘুম থেকে উঠে ২-৩ বার পেশাব করতে হয় তাকে।
বড় ছেলে দুটো ইচ্ছেমত ঘোরে ফেরে খায় দায়, খেলাধুলা করে। দিনে তাদের ৫-৬ বার খেতে হয়, তাও ক্ষুধা লেগেই থাকে।
তো এখন, এই পরিবারটার জন্য ব্যালেন্সড ডায়েট কি হবে??
কোন একটা নির্দিষ্ট ডায়েট কি এই বাসার সবাই ফলো করতে পারবে??
অবশ্যই না।
এই বাসার সবচেয়ে অসুস্থ মানুষটা কে বোঝা যাচ্ছে??
প্রত্যেকের জন্য পারসোনালাইজড ডায়েট প্ল্যান ফলো করার সেক্ষেত্রে উপায়টা কি হবে?? সবার জন্যই কি ডায়েটিশিয়ান বা নিউট্রিশনিস্টের কাছে দৌড়াবেন??
… … …
খেয়াল করলে দেখা যাবে, এই বাসার ৯ জনের মধ্যে ৫ জনই হয় ডায়বেটিক নয়তো প্রিডায়বেটিক। ২জন ডায়বেটিক, ৩ জন প্রি ডায়বেটিক। আজ হোক কাল হোক, ডায়েট আর লাইফস্টাইল চেঞ্জ না করলে এই ৩ জনের ডায়বেটিস হওয়া সময়ের ব্যাপার।
একজন হাইপোথাইরয়েডিজমের রোগী আছে, যে বর্ডারলাইন ওবিস। সামনে তার ওভারিয়ান সিস্ট হওয়ার সম্ভাবনা প্রচুর।
তিনজন বাড়ন্ত বয়সের ছেলেমেয়ে, তাদের বেড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজন প্রচুর নিউট্রিয়েন্টস, প্রোটিন, মিনারেলস আর ভিটামিন্স। ছেলেদের হাড় আর পেশী বেড়ে উঠতে চায় তরতর করে। মেয়েটার কোমর, উরু ও বুক নিতে চায় মেয়েলি গড়ন।
চার সন্তানের মা যিনি, তিনি পরিবারের সবার যত্ন নিচ্ছেন, পাশাপাশি বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন শিশুটিকেও।
চার সন্তানের বাবা পুরুষটিও ঘুরে ফিরে সবার যত্ন নিচ্ছেন আয়ের মাধ্যমে।
এই দুজনের বয়স কাগজ কলমের হিসেবে যৌবনের মাঝামাঝিতে, কিন্তু তাদের শারীরিক অবস্থা বলে, কোষগুলোর বয়স বার্ধক্যের কাছাকাছি পৌছে যাচ্ছে। দুজনেই ডায়বেটিসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন।
তাদের দরকার আরেক রকম ডায়েট। সঠিক ডায়েট আর লাইফস্টাইলের মাধ্যমে তারা স্বাভাবিক যৌবনে ফিরতে পারেন বছরখানেকের ভেতর, ডায়বেটিস থেকেও হয়তো নিরাপদ থাকবেন আরো বহু বছর, ফিরবেন স্বাভাবিক শারীরিক গড়ন আর যৌনজীবনে।
বৃদ্ধ-বৃদ্ধা দুজন জীবনের শেষদিকে। তারা এখন বেশি খেতে পারেন না। অল্প খেলেও ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রনে থাকছে না, ইনসুলিন নিতে হয় সবসময়। ভারী খাবার খেলে শরীর খারাপ করে, প্রেসারও বেড়ে যায়। তাদের কঠিন জীবনটা একটু হলেও সহজ করতে পারবে ডায়েট। অল্প খাবেন, কিন্তু সঠিক খাবারটা খাবেন, তবেই ঝামেলা শেষ। চাইলে, ইনসুলিনও ছেড়ে দেয়া সম্ভব হবে ৬ মাস থেকে ১ বছরের ভেতর।
এদের সবার জন্য ব্যালেন্সড ডায়েট আলাদা আলাদা। কিন্তু ঠিক জ্ঞানটা রাখলে বাসার বাজারের ভেতরেই ম্যানেজ করে ফেলা যায় কখন কার কি দরকার।
বয়স বাড়লেই ডায়বেটিক হতে হবে এটা তো কোন কথা না।
অফিস ওয়ার্ক করলেই ফ্যাটি লিভার নিয়ে ঘুরতে হবে কেন?
বয়স ৩৫ হলেই একজন নারীর প্রি মেনোপজাল সিন্ড্রোম দেখা দেবে কেন?? ৪৫ বছরের আগে তো এটা হওয়ারই কথা না।
১৪ বছরের মেয়ের ওভারিয়ান সিস্ট থাকবে কেন?? কোমর ৩০ ইঞ্চি হবে কেন??
এই সমস্যাগুলোকে ডায়েট এবং লাইফস্টাইল দিয়ে সমাধান করা যায়। কিন্তু ব্যালেন্সড ডায়েট প্রতিটা মানুষের জন্য আলাদা।