ডায়বেটিস-হার্ট ডিজিজ মহামারির কারন?
আমাদের ডায়বেটিস-হার্ট ডিজিজের এই মহামারীর অনেকটাই ব্রিটিশদের শোষনের ফল। আমরা দক্ষিন এশিয়ানরা খুব সহজেই শরীরে চর্বি জমিয়ে ফেলি এবং খুব অল্প মাসল ধরে রাখি, এটাও ব্রিটিশ শাসনের ফল। এর জন্য আমাদের রক্ত-জন্মকে দোষ দিয়ে লাভ নেই।
খুব সম্ভবত ব্রিটিশরা যখন এই অঞ্চলে আসে তখন তাদের আর আমাদের গড় উচ্চতা প্রায় একই রকম ছিল। সুলতানী-নবাবী আমলে আমাদের পাতে ছিল প্রচুর মাছ, যথেষ্ট তেল, ঘি, মাখন, দুধ আর দধি। আমাদের বাড়িতে বাড়িতে ছিল প্রচুর গরু-ছাগল আর হাস-মুরগী। বাংলাদেশ ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী অঞ্চল। পুরো আমেরিকা লুট করে স্প্যানিশরা যা না করতে পেরেছে, এক বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান আর মিয়ানমার লুট করে তার অনেক বেশি করেছে ব্রিটিশরা। তাদের শিল্প বিপ্লব হয়েছে মূলত বাংলার কৃষকের রক্তে লাল পাউন্ডের ওপরে। ব্রিটিশ শাসন যখন শুরু হয় তখন সারা পৃথিবীত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মাথাপিছু উৎপাদন ছিল বাংলাদেশে। প্রথম স্থানে ছিল দক্ষিণ ভারতের মহীশুর সালতানাত। মুঘলরা সারা ভারত থেকে যা খাজনা পেত তার অর্ধেক যেত এক বাংলা থেকে, এরপরেও এত সম্পদ ছিল আমাদের দেশে।
কিন্তু ব্রিটিশ শাসন শুরু হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যে প্রথম যে বড় দুর্ভিক্ষটা ঘটে তা পৃথিবীর ইতিহাসের ভয়ংকরতম দুর্ভিক্ষগুলির একটা। ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামের এই মহাদুর্ভিক্ষে মারা যায় বাংলাদেশের প্রতি তিনজনে একজন মানুষ, মোট মৃতের সংখ্যা ছিল প্রায় এক কোটি!!!
এরপর, ১৮৬৬ সালের উড়িষ্যার দুর্ভিক্ষ, ১৮৯৬-৯৮ সালে হওয়া বাংলার দুর্ভিক্ষে আবারো মারা যায় কয়েক লাখ মানুষ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শুরু হয় আরেক ভয়ংকর দুর্ভিক্ষ, পঞ্চাশের মন্বন্তর নামের এই মহাদুর্ভিক্ষে মারা যায় ১৫ লাখ থেকে ৫০ লাখ মানুষ।
এই বড় বড় দুর্ভিক্ষগুলির ফাকে ফাকে ছোট ছোট আরো প্রায় ডজনখানেক দুর্ভিক্ষ হয় বাংলাদেশে, আর ব্রিটিশ ইন্ডিয়াতে হওয়া মোট দুর্ভিক্ষের সংখ্যা ৩০+।
এই দুর্ভিক্ষগুলিতে বেচে থেকে যারা বংশবিস্তার করতে পেরেছেন, আমরা তাদেরই বংশধর।
ড. মবিন সাঈদ বলেন, স্বাভাবিকভাবেই, ভয়ানক এই দুর্ভিক্ষগুলির সারভাইভারদের মধ্যে দুইটা মেজর এডাপটেশন ঘটেছে।
১) স্টারভেশন এডাপ্টেশন
২) ট্রমা এডাপ্টেশন
স্টারভেশন এডাপ্টেশনের ফলে শরীর খাবার পাওয়ামাত্রই আগে সেটা ফ্যাটে কনভার্ট করতে চায় যাতে ফের যদি না খেয়ে থাকা লাগে, তখন ঐ ফ্যাট পুড়িয়ে শরীর যেন টিকে থাকতে পারে। আবার একই সাথে শরীর চায় যথাসম্ভব কম মাসল ধরে রাখতে। কারন মাসল ধরে রাখা কস্টলি। মাসল ক্যালরি পুড়িয়ে ফেলে, মাসল টিকিয়ে রাখতে বাড়তি প্রোটিন দরকার পড়ে। আমাদের পূর্বপুরুষ তো দুশো বছর ধরে ঠিকমত ভাতই খেতে পান নি, প্রোটিন তো অনেক দুরের কথা।
আবার, ট্রমা এডাপ্টেশনের ফলে শরীর স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি কর্টিসোল ডমিনেটেড থাকে, এজন্যও আমাদের পূর্বপুরুষ ঘন ঘন কার্বোহাইড্রেট খেতে চাইতেন, আর তা সহজেই ফ্যাটে কনভার্ট করে ফেলতেন। যে যত বেশি ফ্যাট জমাতে পেরেছে তখন, তার বেচে থাকার সম্ভাবনা ছিল তত বেশি। যার মাসল মাস যত বেশি, তার দুর্ভিক্ষের সময় খাবারও লেগেছে তত বেশি। সেদিক দিয়ে একটা মোটাসোটা পরিবারের চেয়ে একটা শুকনো পরিবারের দুর্ভিক্ষে টিকে থাকার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
এই এডাপ্টেশন করে টিকে যাওয়া আমাদের শরীর তাই এখনো খুব সহজে ফ্যাট জমায়, মাসল ভেঙ্গে ফেলে, খিটখিটে মেজাজে থাকে, অলসতা করে এবং ভাত দেখামাত্রই ভাতের ওপর ঝাপিয়ে পড়তে চায়। আমাদের বুদ্ধিমত্তা গেছে কমে, আমরা হয়ে গেছি সুযোগসন্ধানী।
ব্রিটিশরা যখন চলে যায়, তখন আমরা পথের ফকির, আমাদের শরীর হাড় জিরজিরে, আর পেটে একটা পুটলির মত ভুড়ি। আমরা অলস, আমরা শারীরিকভাবে দুর্বল। আমাদের পাতের সেই ঘি ভাত উধাও হয়ে গেছে আর এর ঠিক পরপরই শুরু হয়েছে সবুজ বিপ্লব।
ব্রিটিশরা আমাদের ডায়বেটিসে আক্রান্ত হবার রিলেটিভ রিস্ক ইউরোপিয়ানদের তুলনায় ৬০০% বাড়িয়ে দিয়ে গেছে, হার্টের রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বাড়িয়েছে ২৫০%।
হ্যা, আমরা টেকনোলজিক্যাল প্রগ্রেস আর ইংরেজী ভাষা পেয়েছি, কিন্তু বিনিময়ে হারিয়েছি আমাদের স্বাস্থ্য।