যে কারণে কমে যাচ্ছে ন্যাচারাল ডেলিভারি – ৪
যেখানে সব নারীই এক….
বাংলাদেশের বিভিন্ন সামাজিক অবস্থান, বিভিন্ন শিক্ষাগত যোগ্যতা, বিভিন্ন অঞ্চল, বিভিন্ন পেশা, বিভিন্ন পোশাক, বিভিন্ন ধর্ম, বিভিন্ন বয়স এবং বিভিন্ন খাদ্যভ্যাসের নারীদের নিয়ে হওয়া ৬টা স্টাডি পড়লাম। এরমধ্যে ৩টার সাথেই জড়িত আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইন্সটিটিউটের প্রফেসর আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ড. মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান স্যার, আরেকটায় জড়িত আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষিকা ড. খুরশিদা জাহান ম্যাম। আরো একটা স্টাডিতে ছিলেন এশিয়ার নামজাদা নিউট্রিশন সায়েন্টিস্ট ড. খান মওদুদ রহমান। বেশিরভাগ গবেষনাই মূলত ইউনিভার্সিটি অফ হেলসিংকি/ইউনিভার্সিটি অফ গ্রিফিথ, আইসিডিডিআরবি অথবা বারডেমের উদ্যোগে করা।
এই গবেষনাগুলো চালানো হয়েছে যথাক্রমেঃ
১) শহুরে ও গ্রামীন নারীদের ওপর
২) এখনও মা হয় নি এমন কিশোরী-তরুণী এবং মা হয়েছেন এমন কিশোরী-তরুণীদের ওপর
৩) গর্ভবতী ও স্বাভাবিক যুবতীদের ওপর
৪) শিশুকে দুধ পান করাচ্ছেন এমন নারীদের ওপর
৫) বোরকা পরেন এবং বোরকা পরেন না এমন নারীদের ওপর
৬) গার্মেন্টস শ্রমিক ও গৃহবধুদের ওপর
৭) অফিস করছেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন এমন নারীদের ওপর
সর্বশেষ,
৮) ডায়বেটিক ও পোস্ট মেনোপজাল নারীদের ওপর।
এই সমস্ত স্টাডির কমন রেজাল্ট হচ্ছে, ভিটামিন ডি’র অভাব।
১) গার্মেন্টস শ্রমিকদের ৯৯% ভিটামিন ডির অভাবে ভুগছে।
২) বোরকা পরা ও না পরা নির্বিশেষে ভিটামিন ডি লেভেলে যে তফাৎ দেখা গেছে তা ছিল অতি সামান্য, তারমানে এটা বলা যাচ্ছে না যে বোরকা পরার কারনে মেয়েরা বাড়তি ভিটামিন ডি’র অভাবে ভোগে(আমার ক্লিনিক্যাল এক্সপেরিয়েন্স ভিন্ন কথা বলে)
৩) কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী এবং ডেস্কজব করা নারীদের প্রায় ৪৮-৬১%, কোন কোন ক্ষেত্রে ৭৪% পর্যন্ত ভিটামিন ডি’র অভাবে ভুগছেন।
৪) যারা শিশুকে দুধ পান করাচ্ছেন তাদের প্রায় ৮৭% ভিটামিন ডি’র অভাবে ভুগছেন।
৫) ডায়বেটিক এবং পোস্ট মেনোপজাল নারীদের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশই ভিটামিন ডি’র অভাবে ভুগছেন।
৬) পুরুষদের মধ্যে ৩৩-৪৮% ভিটামিন ডি’র অভাবে ভুগছেন
৭) ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের প্রায় ৭০% ভিটামিন ডি’র অভাবে ভুগছে।
ভিটামিন ডি’র সাথে আমাদের শরীরের যে দুটো সবচেয়ে জরুরী বিষয় জড়িত তা হচ্ছে বোন এন্ড মাসকুলার সিস্টেম। আমাদের হাড়ের গড়ন ও পেশীর শক্তি অনেকাংশে ভিটামিন ডি’র ওপর নির্ভরশীল।
এই গবেষনাগুলোতে বেরিয়ে এসেছে আরেকটি তথ্য, শতকরা আশি শতাংশের বেশি বাংলাদেশী নারী পাতলা হাড়ের সমস্যায় ভুগছেন।
নিউট্রিশন সায়েন্সের সমস্ত কোর্সে একটা কথা জোর দিয়ে বলা হয়, নারীদের সুস্থ রাখা গেলে পরের দুই-তিন প্রজন্মে একটা জাতিই বদলে যাবে। দুঃখজনকভাবে, আমাদের নারীরা নিদারুন পুষ্টির অভাবে ভুগছেন কিন্তু সচেতনতার অভাবে আমরা তা জানিই না।
ভিটামিন ডি’র এত অভাবের প্রধান কারন হিসেবে অনেকেই রোদে চলাচলকে দায়ী করেন, কিন্তু এই বক্তব্য রিসার্চের ওপর ভিত্তি করে উড়িয়ে দেয়া সম্ভব। রোদে বেশি থাকছেন এমন নারীদের ভিটামিন ডি লেভেল উল্লেখযোগ্য রকম বেশি নয়।
ন্যাচারাল ডেলিভারিতে সরাসরি ভিটামিন ডি’র কোন ভুমিকা নেই। কিন্তু কোমরের হাড় ও পেশীর সহ্যক্ষমতা-শক্তি প্রয়োগের ক্ষমতার সাথে সরাসরি জড়িত ভিটামিন ডি। সন্তানকে পৃথিবীতে আনতে যে চাপ প্রয়োগ করতে হয়, অনেকক্ষেত্রেই একজন ভিটামিন ডি’র অভাবে ভোগা মায়ের পক্ষে তা প্রয়োগ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। ভিটামিন ডি লেভেল ঠিক থাকলে মানুষের কষ্টসহিষ্ণুতাও বাড়ে। ন্যাচারাল লেবার পেইন সহ্য করার জন্য যে কষ্টসহিষ্ণুতা প্রয়োজন তার জন্য দরকার ভিটামিন ডি।
বিশ্বব্যাপী কনজারভেটিভ এস্টিমেটে ১০০ কোটি এবং লিবারেল এস্টিমেটে আনুমানিক ২৫০ কোটি মানুষ ভিটামিন ডির অভাবে ভুগছে।
আমি গভীরভাবে বোঝার চেষ্টা করছি, কি কি কারনে বাংলাদেশে ন্যাচারাল ডেলিভারি কম হচ্ছে।
প্রায়ই শুনি, প্রসুতি মায়েরা শেষ সময়ে এসে লেবার শুরু হওয়া মাত্রই হাল ছেড়ে দিচ্ছেন। আমার ধারনা, ভিটামিন ডি লেভেল বাড়াতে পারলে এটা থেকে বেরিয়ে আসার পথ ধীরে ধীরে উন্মুক্ত হতে শুরু করবে ইনশা আল্লাহ।