ইনসুলিনের ইতিহাস নিয়ে জানুন
আমরা বারবার দেখলাম, ঐতিহাসিকভাবেই, ডায়বেটিসের সমস্যাকে মানুষ কার্বোহাইড্রেট এবং ক্যালরির পরিমান কমিয়ে মোকাবিলা করতে চেষ্টা করেছে অথবা, দীর্ঘক্ষন না খেয়ে বা দীর্ঘদিন অত্যন্ত কম খেয়ে নিয়ন্ত্রনে রাখতে চেষ্টা করেছে।
১৯২১ সালে কৃত্রিম ইনসুলিন আবিষ্কারের পর জানা গেল, না এই সমস্যাকে এড়ানোর একটা উপায় আছে। তা হচ্ছে ইনসুলিন নেয়া।
ইনসুলিন আবিষ্কারের আগে টাইপ ১ ডায়বেটিস হলে মানুষ গড়ে মাত্র ১৬ মাস বাচতো, কিন্তু ইনসুলিন আবিষ্কারের পর তারা ৩৫ বছর পর্যন্ত বেচে থাকা শুরু করলো।
টাইপ ২ ডায়বেটিসের ক্ষেত্রেও ইনসুলিন জীবনকে সহজ করলো বটে, কিন্তু অতি শিগগিরই দেখা গেল এক সমস্যা।
মানুষ ইনসুলিন নিচ্ছে, কিন্তু কিছুদিন পর তার শরীরে আর ইনসুলিন কাজ করছে না। এই সমস্যার কারন অনুসন্ধান করতে নামলেন বিশেষজ্ঞরা। ১৯৩৬ সালে ড. স্যার হ্যারল্ড হিমসওয়ার্থ উল্লেখ করলেন, যে এক ধরনের ডায়বেটিস রোগী আছে যারা ইনসুলিন নিলেও রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমে না। ১৯৪৮ সালে ড. জসলিন বললেন, বহু মানুষের শরীরেই ইনসুলিন ঠিকভাবে কাজ করে না এবং এই ধরনের অনেক মানুষ আমাদের চারপাশে আছে যাদের ডায়বেটিস ধরা পড়ছে না। এই সমস্যাকে তিনি অভিহিত করেন ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স বলে। এন্টিবায়োটিক বেশি নিলে যেমন শরীর এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট হয়, তেমনি অতিরিক্ত ইনসুলিনের সংস্পর্শে এসে শরীরের কোষ হতে পারে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্ট।
মানুষ ঠিক কিভাবে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্ট হয়ে ওঠে, তা জানা যায় আরো একটু পরে।
এর মধ্যে ১৯৪৫ সাল থেকে রেডিওএক্টিভ পরমানু চিকিৎসার কাজে ব্যবহার করা শুরু হয়।
১৯৫১ সালে ড. ইয়ালৌ ও তার স্বামী ড. বারসন তাদের করা গবেষনায় দেখান, রক্তে উচ্চমাত্রার ইনসুলিন উপস্থিত থাকলে শরীরের কোষ এটাকে এন্টিজেন হিসেবে শনাক্ত করে এন্টিবডি নিঃসরন করে। এই এন্টিবডি নিঃসরনের ফলেই মূলত মানুষ ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্ট হতে শুরু করে।
এই গবেষনার স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৬০ সালে এই দম্পতি নোবেল পুরস্কার পান।
কিন্তু এতে পরিস্থিতির কোন পরিবর্তন হল না।
ড. জসলিন যেখানে শেষদিকে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সের দিকে গুরুত্ব দিচ্ছিলেন, সেখান থেকে ফোকাস চলে গেল গ্লুকোজ ম্যানেজমেন্টের দিকে। মানুষ মনে করলো, কঠিনভাবে রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রন করতে পারলেই বুঝি ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রনে রাখা সম্ভব।
শুরু হল বিশ্বব্যাপী স্ট্যান্ডার্ড ডায়েটারি গাইডলাইন তৈরির কাজ, আর এর মধ্যেই ঢুকে পড়লো বিগ মানির কারবার।
পৃথিবীব্যাপী সুগার ইন্ডাস্ট্রি একজন বিজ্ঞানীকে চেপে ধরলো, আরেকজনকে ওঠালো আকাশে।
ব্রিটিশ ফিজিওলজিস্ট ড. জন ইয়ুডকিন বলছিলেন, সুগার ও ধুমপান হচ্ছে হৃদরোগের সবচেয়ে বড় কারন। ইয়ুডকিন মনে করতেন, সুগার ডায়বেটিস ও ফ্যাটি লিভার হওয়ার পেছনেও সবচেয়ে বেশি দায়ী। পাশাপাশি তিনি মানুষের একটানা কার্বোহাইড্রেট খেয়ে যাওয়াকে এসব মেটাবলিক ডিজিজের জন্য দায়ী করেন।
ওদিকে আমেরিকান নিউট্রিশনিস্ট মার্ক হেগস্টেডকে প্রায় কাছাকাছি সময়েই সুগার রিসার্চ ফাউন্ডেশন সে সময়কার সাড়ে ছয় হাজার ডলার ‘ডোনেট’ করে, যার ফলে হেগস্টেড মূলত বাড়তি ওজন ও হৃদরোগ সহ অধিকাংশ মেটাবলিক ডিজিজের পেছনে ফ্যাটের ভুমিকা আছে বলে রিসার্চ পাবলিশ করেন।
অন্যদিকে, জন ইয়ুডকিনকে এক অদৃশ্য শক্তির জোরে ধীরে ধীরে মুছে ফেলা হয় সমস্ত জায়গা থেকে।
১৯৮০ সালে তৈরি হওয়া আমেরিকান ডায়েটারি গাইডলাইনে জনগনকে উৎসাহিত করা হয় দৈনিক ক্যালরির মোট ৫৫-৬০% কার্বোহাইড্রেট থেকে নিতে। তারপর, আমেরিকার দেখাদেখি ইউকে এবং বাকি দেশগুলিও প্রায় একই রকম ডায়েটারি গাইডলাইন তৈরি করে।
মূলত এই গাইডলাইনগুলি অনুসরন করেই এখনো ডায়বেটিস রোগীদের চিকিৎসায় হাসপাতালগুলিতে ব্যবহার করা হয়। আমি মাউন্ট এলিজাবেথ, জন হপকিন্সসহ বিশ্বখ্যাত কয়েকটি হাসপাতাল থেকে ডায়েটারি গাইডলাইন নিয়ে আসা রোগীদের ম্যানেজ করছি এবং তাদের ১২০-১৫০ ডলার খরচ করে বানিয়ে আনা ডায়েট চার্ট দেখেছি। এখনো বেশিরভাগ বড় প্রতিষ্ঠানের ডায়েটারি প্রোটোকল ১৯৮০ সালে তৈরি করা ৫৫-৬০% কার্বোহাইড্রেট এবং লো ফ্যাট ডায়েটে আটকে আছে, এটাই বাস্তবতা।
কিন্তু, এই ডায়েট চার্টগুলো তাদের কাজে আসে নি বলেই, তারা আমার কাছে আসেন। কেননা, কারো শরীরে যখন ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স থাকে, এই ধরনের ডায়েট চার্ট তাকে বেশিদিন ভাল রাখতে পারে না।
১৯৮০ সালে আমেরিকান ডায়েটারি গাইডলাইন তৈরি হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত বিশ্বে ডায়বেটিক রোগীর সংখ্যা ৫০০% বেড়েছে। চীনে বেড়েছে প্রায় ১২০০%, ভারতে ২০০৭-২০১৭ সালের মধ্যে ডায়বেটিক প্যাশেন্ট বেড়েছে ৪০ মিলিয়ন থেকে ৭২ মিলিয়নে, ২০৩০ সালে আনুমানিক ৭৯ মিলিয়ন ভারতীয় ডায়বেটিক হবে এবং ২০৪৫ সালে ১৩৪ মিলিয়ন ভারতীয় ডায়বেটিক হবে।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, ডায়েটারি গাইডলাইন সমন্বিতভাবে বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ জোর দেয়ার পরেও ডায়বেটিস শুধু বাড়ছেই।
কারন, এই ডায়েটারি গাইডলাইনের উদ্দেশ্য ডায়বেটিসের উপসর্গ নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা করা, রোগের মূল কারনের সমাধান করা নয়।
গ্লুকোজ ম্যানেজমেন্টকে যতটা গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সকে কমানোর দিকে ততটা গুরুত্ব দেয়া হয় নি।
কিন্তু গত পনেরো বছরে নিউট্রিশন সায়েন্স বদলে গেছে অনেক। আমেরিকান ডায়বেটিক এসোসিয়েশান, ডায়বেটিস ইউকের মত শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানগুলো এখন ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সকে টাইপ টু ডায়বেটিসের অন্যতম প্রধান কারন হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যেই আমেরিকা তাদের নতুন গাইডলাইনে ডায়েটারি ফ্যাটের ওপর রেস্ট্রিকশান তুলে দিয়েছে।
পরিবর্তন আসছে ঠিকই, কিন্তু বাংলাদেশের প্রায় কোন হাসপাতাল ও কোন বিশ্ববিদ্যালয়ই এই পরিবর্তন এখনো গ্রহন করেনি।
তাই বলে, আমরা থেমে যেতে পারি না। নিউট্রিশন সায়েন্স দেখাচ্ছে, টাইপ টু ডায়বেটিস নিরাময়ের অতীত নয়, টাইপ টু ডায়বেটিসের সমাধান আছে। আর সেই সমাধান আসবে ৫ ধরনের ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে।
১) থেরাপিউটিক ফাস্টিং, ১৮+ ঘন্টা
২) থেরাপিউটিক লো কার্ব ডায়েট, ৮-২৪ মাস(মাঝে ব্রেক লাগতে পারে)
৩) স্লিপ ও স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট
৪) এক্সারসাইজ এবং
৫) সাপ্লিমেন্টেশান
এখন পর্যন্ত ডায়বেটিসের ম্যানেজমেন্ট ওষুধ-ইনসুলিন নির্ভর, কারন বেশিরভাগ ডায়েটই ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স কমানোর জন্য উপযুক্ত না।
আমরা যারা ডায়বেটিসের বোঝা থেকে বাংলাদেশকে ভবিষ্যতে হালকা করতে চাই, তারা কাজ করে যাচ্ছি আমাদের চারপাশটা বদলে দিতে।
আমাদের সাথে থাকুন।